বিয়োগ ব্যথা – মো. মাকছুদুল হাসান

আসতে পারি স্যার?

“লজ্জা দিবেন না মশাই
ডিপার্টমেন্টের জামাই
আপনি বিহনে ক্লাসটা আমি
কেমন করিয়া করাই”

স্যারের মুখে ভয়ানক কবিতা শুনেই বুঝে ফেললাম এই কাজ শুভ রে ছাড়া কেউ করে নাই।( শুভ আমাদের ক্লাসের একমাত্র গুজব প্রচারকের মহান দায়িত্বে নিয়োজিত)
অতপর স্যার বললো মশাই,আপনি আজকে তো এভারেস্টের অর্ধচূড়া জয় করে ফেলছেন।
আপনি আজ মাত্র ৮ মিনিট দেরিতে আসছেন।

কোনো এক হামলা পাল্টা হামলায় ক্যাম্পাস সেদিন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ দেওয়া হলো। আমি পরেরদিন সকাল নয়টার বাসের টিকিট কাটলাম।

সকাল পাঁচটা “সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা” গানের বিদঘুটে কন্ঠ শুনে এক লাফে উঠে পড়েছি। আরে আমি তো এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। কি পদোন্নয়ন মাইরি!
গানটি যদি আমার কন্ঠ বাদে আসল শিল্পীর কন্ঠে বাজতো তবে পদোন্নতির আস্ফালনে বারোটা বাজতো। শুভর প্রতি আমার রাগটা আর রাখা উচিত না।তার এই একটা পরামর্শ ভালোই কাজে লেগেছে।

গোসল খাওয়া দাওয়া সেরে প্রস্তুত হচ্ছি। দীর্ঘদিন পর বাড়িতে যাবো। পারফিউম খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত লাগছে।অবশেষে পাশের রুমের বড় ভাইকে বললাম ভাই,আপনার পারফিউম টা একটু দেওয়া যাবে? ভাই বললো আছে তো। কিন্তু এটা ঊর্মির দেওয়া গিফট। আমি এখনো খুলি নাই। এটা কোনো সমস্যা ভাইয়া?আপনি প্রথমে একটু লাগিয়ে আমাকে দেন।ভাইয়ার মলিন মুখ দেখে মায়া হচ্ছে। কি আর করা স্বপ্রণোদিত হয়ে বেডে শায়িত ভাইয়ার কাথার উপর একটু পারফিউম লাগিয়ে নিজের শরীরে লাগিয়ে চলে আসলাম।

ব্যাগটা কাধে নিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটছি।এলোমেলো কত চিন্তায় হাতছানি দিচ্ছে। কোনো সময় ভাবি, ইশ! সিনেমা বা গল্পের মতো যদি কোনো এক অপরিচিতার সিট আমার পাশে থাকতো।
পরক্ষণে মাথায় আসে এসব অলক্ষুণে চিন্তা কেনো যে মাথায় আসে।আমি তো মেয়েদের সাথে তেমন কথায় বলতা পারি না। পাশে বসলে লজ্জায় ইতস্তত বোধের যন্ত্রণায় পড়বো।

যাহোক অবশেষে নাসা এক্সপ্রেসের গাড়ির মাঝ বরাবর একটা সিটে বসলাম।গাড়িটি বেশ নতুন ই লাগছে।বিশেষ করে রঙটা বেশ ঝলমলে। হয়তো গড়িটি রাস্তায় নেমেছে বেশি দিন হয় নি।যাত্রীরা এক এক করে উঠছেন।আমার পাশের সিটের মানুষ এখনো আসেন নি।কিন্তু ঝলমলে বাসটিকে আমার কাছে তখনো কেমন যেনো গম্ভীর গম্ভীর লাগছে।যেনো একটা ঘোর রহস্যে আচ্ছাদিত।

কিন্তু এই গম্ভীরতাকে বেশী সময় স্থায়ী হতে দিলো না এক পরিবার।অনুমান করি পরিবারটি কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছে।মাঝারী গোছের ফর্সা একজন ভদ্রলোক,বয়স ৪৫ এর মতো,মাথার অগ্রভাগে চুল বেশি একটা নেই,হালকা গোফে সহাস্যমুখ খানা ভালোই মানিয়েছে।উনি তার স্ত্রী সহ ৩ কন্যাকে নিয়ে উঠেছেন।ছোট কন্যাটি বেশ চঞ্চল।
বাসে উঠেই তার বাবা কে বললো, আব্বু, আমি কিন্তু জানালার পাশের সিটে বসবো।
বাবা বললেন,জানালার পাশে বসলেই কি হয় মামুনি?

মেয়ে উত্তর দিলো “চেন্নাই এক্সপ্রেস” মুভিতে দীপিকা নাকি জানালার পাশে বসেছিল।
বাসের সবাই যখন মুচকি হাসছে বাবা তখন থ হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে।

মাঝারি মেয়ে বললো আরে ওটা তো ট্রেন ছিল এটা বাস।বাসে বসে ট্রেনের কথা বলে লাভ নেই।
এখন পিচ্চি মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, এই বাসের নাম কি?
মাঝারি মেয়ের উত্তর,”নাসা এক্সপ্রেস”।
দীপিকা যেটাতে ছিল সেটার নাম কি?
“চেন্নাই এক্সপ্রেস।”

এবার যুক্তিবাদী উত্তর,এটাও এক্সপ্রেস সেটাও এক্সপ্রেস।সো আমি জানালার পাশেই বসবো।( বাহ! অসম্ভব যুক্তিবাদী)

ঠিক তখনই আমার পাশের সিটের সহযাত্রী মহাশয় এসেছেন।
এসেই সালাম দিলেন।মাথায় টুপি পরিহিত ধার্মিক গোছের লোক। বেশ স্বাস্থ্য-সমন্বিত,মুখে সুন্দর দাড়ি,কালো মুখের বিনম্র চোখ যেন ঝলমল করছে।
ব্যাগ সিটের উপরের তাকে রেখে বসলেন।

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্চ দিল।জানালার ফাক দিয়ে নির্মল বাতাস আসছে।এই রাস্তা যতই চেনা হউক না কেনো,বরাবর আমার দৃষ্টি বাহিরের প্রকৃতি দেখতেই ব্যাস্ত থাকে।আজ আমার দৃষ্টি বাহিরে থাকলেও মনটা যেনো ভেতরেই পড়ে আছে।

এক অচেনা সুর, অচেনা মুখ, সেই মুখে যে একটা অসম্ভব মায়া বিদ্যমান। সে চোখ খুব শান্ত,অন্য দুইবোনের মতো চঞ্চল নয় সে চোখ। এক অন্যরকম ভালোলাগার মায়ায় পড়েছি।
মাঝে মাঝে সেই চোখ দেখতে ইছে করলেও সে আমার মতোই তার চোখজোড়া জানালার বাইরের দিকে নিবন্ধ করে রেখেছে।
কিন্তু অনুভবে যেন সেই চোখ আমি দেখতে পাচ্ছ।

এইসব চিন্তায় যখন আমি ডুবে আছি।আমার সহযাত্রীর ডাকে কল্পজগত থেকে বের হলাম।এই ভদ্রলোকের সাথে সাধারণভাবে পরিচিত হলাম। তারপর তো আস্তে আস্তে অনেক কথা। উনার কন্ঠে এক ধরণের ভারিক্কী ভাব আছে।আমার মনে হলো উনার গলায় রবি ঠাকুরের “হঠাৎ দেখা” কবিতাটি বেশ মানাবে।

জানতে পারলাম তিনি একজন শিক্ষক। বাবা ছোট বেলায়ই গত হয়েছেন।একমাত্র মা অনকে কষ্টে উনাকে বড় করেছেন। তিনি আমাকে উনার মায়ের গল্প শুনালেন। সেই মায়ের গল্পের আড়ালে আমি আমার মা কে নিয়ে ভাবছি। মা যে প্রত্যেকটা গল্পের পিছনের নায়ক।

উনার হঠাৎ বাড়ি যাওয়ার কারণ মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ছেলেকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ছেন।

গল্পে গল্পে আমি যে এতপথ পেরিয়ে কিভাবে আমার গন্তব্যে চলে আসলাম, সেটা জানিনা।আজ মনে হলো আইনস্টাইন এর আপেক্ষিকতা সূত্রের বাস্তবতা অনুভব করলাম।
মনে হলো এই না কিছুক্ষণ আগেই গাড়িতে উঠলাম।

বাড়িতে আসামাত্রই মা বললো আমি শুকিয়ে গেছি।মুখটা কেমন মরা মরা হয়ে গেছে।নিশ্চয় ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করি না।অনুযোগের সুরে এই কথাগুলো আমার কাছে খুব পরিচিত।
ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিলাম। গ্রামের বন্ধুদের সাথে দেখা করলাম।বেশ ভালো একটা আড্ডা হলো।তাদেরকে বাসে দেখা সেই অপরিচিতার কথা শুনালাম।

রাতের খাবার খেয়ে মা-বাবার সাথে টিভি দেখছি।নিচের শিরোনামে লিখা “ময়মনসিংহগামী নাসা এক্সপ্রেস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে ১০ জন নিহত। আহতদেরকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের মাঝে অনেকের অবস্থা আশংখাজনক”।

এক অজানা বিয়োগ ব্যাথায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।কত আশা, হতাশা,ব্যর্থতার আধারে পুরো রাত আমি নির্ঘুম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!