লোডশেডিং ও বিপণিবিতান বন্ধে সমন্বয় হোক

বর্তমানে রাত ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করা এবং দৈনিক এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং দেশের ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়া ঘা স্বরূপ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ব্যবসাবান্ধব বাংলাদেশ গড়ার পথে এটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সমগ্র বিশ্ব যখন কভিড-১৯ এর মরণ ছোবলে জর্জরিত; মুদ্রাস্ম্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে অর্থনীতির ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, ঠিক সেই মুহূর্তে গত ২০ জুন থেকে মার্কেট, বিপণিবিতান ও দোকান রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ করতে হচ্ছে। বর্তমানে মাগরিবের নামাজ শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে। রাত ৮টায় দোকানপাট বন্ধের কারণে ঈদের আগে এবং পরে ৬০-৭০ শতাংশ দোকানে তেমন বেচাকেনা হয় না। অথচ দোকান মালিকদের কর্মচারী খরচ, বিদ্যুৎ বিল, দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বহন করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই অর্থ সংকটে পড়েছেন।
লোডশেডিংয়ের সময় সংশ্নিষ্ট এলাকার সব স্থাপনাই এর আওতায় আসে। লোডশেডিং চলাকালে অনেকেই জেনারেটর ব্যবহার করে, যেখানে ডিজেলই একমাত্র ব্যবহার্য। শুধু শিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং নয়; বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণেও অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় বিদ্যুৎ বন্ধের ফলে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে। এতে ব্যবসারও ক্ষতি হচ্ছে। বর্তমান সরকারের শাসনামলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আমরা মানুষকে বলতে শুনেছি, লোডশেডিং এখন জাদুঘরে। বর্তমানে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে হঠাৎ ১৯ জুলাই থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয় জ্বালানি সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ১-২ ঘণ্টা লোডশেডিং দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নেয়। উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সারাদেশে লোডশেডিং কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী কয়েক দিন আগে জানিয়েছেন, আমদানিকৃত জ্বালানির (ডিজেল, এলএনজি) মাত্র ১০ শতাংশ ব্যবহার হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যুতের কোনো সংকট নেই; সংকট জ্বালানিতে। বাকি ৯০ শতাংশ ব্যবহার হয় পরিবহন ও কৃষি খাতে। মাত্র ১০ শতাংশ সাশ্রয়ের জন্য সমালোচকদের সমালোচনা করার সুযোগ কেন করে দেওয়া হলো? বলতে শোনা যায়, এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়? রেন্টাল বিদ্যুতের কারণেই এই দুরবস্থা। বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনাসহ তির্যক ভাষায় সমালোচনা গণমাধ্যমে আসছে। এই লোডশেডিংয়ে কতটা কাজ হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অথচ এর ফলে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনেকেই পথে বসার উপক্রম।
লোডশেডিং ছাড়া যদি ডিজেল ও এলএনজির দামে সমন্বয় করা হয়, তাতে সরকারের ভর্তুকি কমবে। মানুষ সাশ্রয়ী হবে। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। শুধু ১-২ ঘণ্টা অপরিকল্পিত লোডশেডিং কর্মসূচির কারণে পুরো অর্জনই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। পিডিবির তথ্যমতে, দেশে জ্বালানি তেলে পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০টি। জ্বালানি তেলে পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখলে এক দিনে জ্বালানি সাশ্রয় হয় ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। এক দিন দোকানপাট বন্ধ রাখলে ক্ষতি হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে রাত ৯টার পরিবর্তে রাত ৮টায় দোকান বন্ধ রাখলে, অর্থাৎ ১ ঘণ্টায় ক্ষতি হয় ১৬০ কোটি টাকা।ব াস্তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। কারণ মার্কেট, বিপণিবিতান ও দোকানগুলোয় বেচাকেনা শুরু হয় মূলত সন্ধ্যার পর।
যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বাঙালি জাতির মহানায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং উন্নয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। এ ব্যাপারে আমাদের অনুরোধ, এই মুহূর্তে লোডশেডিং থেকে সরে এসে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হোক।
উল্লেখ্য, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এক লিটার ডিজেলের দাম ১০৬ রুপি, আমাদের দেশে ৭৮ টাকা। সুতরাং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় না হলে প্রতিবেশী দেশে তা পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। প্রকৃত অর্থে লোডশেডিং কোনো কার্যকর সমাধান নয়। বিআইডিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যানজটের কারণে ঢাকা শহরে যানবাহনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩-৪ কিলোমিটার। এতে যে পরিমাণ জ্বালানি অপচয় হয় তার বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। সেই সঙ্গে কর্মঘণ্টা যোগ করলে বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অতএব, লোডশেডিং নয়, বরং অপচয় কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
কয়েক দিন আগে ভোজ্যতেলের দামে সমন্বয় করা হয়েছে। সমন্বয় মানে দাম বৃদ্ধি পেলে বর্ধিত দামে ক্রয় ও দাম কমে গেলে কম দামে ক্রয় করা। বর্তমানে ভোজ্যতেল নিয়ে ভোক্তার কোনো অভিযোগ নেই। একইভাবে জ্বালানি তেলের দামে সমন্বয় করা হলে ভোক্তার কোনো আপত্তি থাকবে না। এতে ভোক্তা এবং রাষ্ট্র উভয়েই ভালো থাকবে। সমালোচকদেরও সমালোচনা বন্ধ হবে। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ দেশের ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি- ক্ষুদ্র ও অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বৃহত্তর স্বার্থে লোডশেডিং বন্ধ করা হোক; মার্কেট, বিপণিবিতান ও দোকানগুলো দুপুর ১২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যবস্থা করা হোক; অফিসের সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিট থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত করা হোক এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত খোলা রাখা হোক। এতে অসহনীয় যানজট কমে আসবে, জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে এবং মানুষের কর্মঘণ্টাও বৃদ্ধি পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখকঃ
মো. হেলাল উদ্দিন
সভাপতি, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই।