শিক্ষক নির্যাতন ও প্রাসঙ্গিক কথা

প্রাচীন কাল হতেই শিক্ষকতা একটা সম্মানজনক পেশা হিসাবে সবার কাছে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই মর্মে অনেক গল্প-কবিতাও রচনা হয়েছে।
কিন্তু, তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে গত কয়েকবছরে শিক্ষক নির্যাতনের যে ঘৃন্য চিত্র উঠে এসেছে এবং বর্বরতার সকল সীমানা যেভাবে অতিক্রম করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এ পেশার মর্যাদা নিতান্তই মুখেমুখে এবং এ নিয়ে নতুন করে ভাবার সময়ও হয়েছে।
সবকিছু দেখেশুনে শিক্ষক নির্যাতনকে আমি দুই ভাগে ভাগ করছি–
০১। আর্থসামাজিক নির্যাতন।
০২। মনো-দৈহিক নির্যাতন।
আর্থসামাজিক নির্যাতন হলো আর্থিক অস্বচ্ছতার মাধ্যমে সামাজিক ভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা। শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগসুবিধা হতে বঞ্চিত করা ও সময়মতো তাঁর পাওনা পরিশোধ না করাও আর্থসামাজিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে।
এবং মনো-দৈহিক নির্যাতন বলতে মানসিক ও শারীরিক বা দৈনিক নির্যাতন।
কি ঘটেনি শিক্ষকদের ভাগ্যে? নিত্য অভাবকে সঙ্গী করে জীবনধারণ করা শিক্ষকরা ‘কর্মস্থল কিংবা সমাজ’ সবখানেই নির্মম বর্বরতার স্বীকার হচ্ছেন।
আর্থিক জরিমানা, সাময়িক বহিষ্কার, চাকরিচ্যুত করা,একঘরে করা, ভিটা-বাড়ি ছাড়া করা, বাড়ি-ঘর ভাংচুর, হামলা-মামলা, বিচারের নামে অপমান ও অপদস্ত, ছুরিকাঘাত, এসিডদগ্ধ, শারীরিকভাবে প্রহারের মাধ্যমে ক্ষতবিক্ষত করা, কানেধরে ওঠবস করানো, জুতার মালা এমনকি শিক্ষকের শরীরে মানুষের মল ঢালা! এ সবই নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মানুষরুপি কিছু অমানুষ ও হায়নাদের কাছে!
আর,অবলা শিক্ষকরাও নিরবে নিভৃতে সব সয়ে যাচ্ছেন! যেনো দেখার ও বুঝার কেউ নেই। প্রতিকার তো দূর সমবেদনা প্রকাশেরও যেনো কেউ নেই।
কিন্তু, কেন এই নির্যাতন? কেন এই নির্মমত? এর কিছু কারণ পর্যালোচনা করাই আমার আজকের লেখার মুল উদ্দেশ্য।
শিক্ষক নির্যাতনের ধরন ও উদ্দেশ্য গুলো দেখে এবং বিশ্লেষণ করতেগিয়ে যে কারণ গুলো আমি খুঁজে পেয়েছি সেগুলো নিম্নরুপ —
০১।শিক্ষক নেতাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, তেলবাজি ও স্বার্থান্ধতা।
০২। রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা।
০৩। আমলাদের বিমাতা সুলভ আচরণ।
০৪। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উদাসীনতা।
০৫। ‘সরকারি’ ও ‘বেসরকারি’ নামক বৈষম্যের নিষ্ঠুর দেয়াল।
০৬। বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুযোগসুবিধা ও মর্যাদার দৃশ্যমান বৈষম্য ও তা দূরীকরণে আন্তরিকতার অভাব।
০৭। আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট ঘাটতি।
০৮। নগ্ন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।
০৯। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়।
১০। মিডিয়া বা গণমাধ্যম গুলোর উদাসিনতা। এবং
১১। শিক্ষকদের পেশাগত দায়িত্বশীলতা, আদর্শ ও নৈতিকতা সহ সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ঘাটতি।
উল্লেখিত কারণগুলোর ২/৩ টার ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন মনে করছি।
নিজেদের দিয়েই শুরু করছি। বেসরকারি শিক্ষকরা সত্যিই কপালপোড়া। আমরা যখন যে ডাল ধরেছি সে ডালই মরমর করে ভেঙে পড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে বেসরকারি শিক্ষকরা যখনই যে নেতার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন সে নেতাই শিক্ষকদের সমর্থন ও সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে নিজের আখের ঘুচিয়েছেন। বর্তমানেও এ ধারা বিদ্যমান রয়েছে। কেউ অবসর ও কল্যাণের চেয়ারটাকে পৈতৃক সম্পত্তির মতো ব্যবহার করছেন। কেউ আবার সেটার দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছেন। কেউ আছেন একটা কাগজে দু-এক কলম লিখে দু’চারটা ছবি তুলে প্রচারে ব্যস্ত। ভাবটা এমন যেনো তিনি ছাড়া শিক্ষকদের কান্ডারী আর কেউ নেই। আদতে, পুরোটাই ভেলকিবাজি ও প্রতারণা। কেউ কেউ আবার ‘কাটার মাস্টার’ হিসাবে শিক্ষক সমাজে দারুণ সুখ্যাতি পেয়েছেন।
তাঁরা প্রত্যেকেই তেলবাজি আর রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে নিজেদের নিমজ্জিত রেখেছেন। এদের কেউ কেউ আবার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ছবিকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করে যারযার আখের ঘুচাতে ব্যস্ত রয়েছেন। এর বাস্তব প্রমাণ হলো গত সংসদ (জাতীয়) নির্বাচনে শিক্ষক নেতাদের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশার দীর্ঘ লাইন।
সাধারণ শিক্ষকদের দেওয়া চাঁদার টাকায় সংগঠন চালিয়ে তাঁরা নিজেদের আখের ঘুচাতে এতোটাই ব্যস্ত যে শিক্ষকের শরীরে মানুষের মল ঢালা, জুতার মালা পড়ানো বা নির্মম ভাবে শারীরিক প্রহার এ সবের কোন কিছুই তাদের চোখ ও কান কোনটিকেই বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। স্বার্থের ঠুলিতে এসব নেতারা এতোটাই নিমজ্জিত যে শিক্ষক নির্যাতনের প্রশ্নে তারা অন্ধ ও বধির হয়ে গেছেন।
তবে, এক্ষেত্রে একটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ফোরাম’ সম্পূর্ণভাবে ব্যতিক্রম ও বিপরীত বৈশিষ্ট্যের বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। ফোরামের জন্মলগ্ন হতেই দেখে আসছি যে ওরা যখন যেখানেই শিক্ষক নির্যাতনের খবর পেয়েছে সাথে সাথে তাদের নেতৃবৃন্দ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিকারও এনেদিয়েছেন।
এই যদি হয় আমাদের নেতাদের অবস্থা তাহলে আমরা বেসরকারি শিক্ষকরা যে এখনো টিকে আছি সেটাই অনেককিছু।
এবার আমলাদের দিকে তাকাই।
আমলাদের কথা আর কি বলব। তাদের কথাবার্তা শুনে ও কর্মকান্ড দেখে মনেহয় তারা সবাই স্বশিক্ষিত। তাদের চৌদ্দ গোষ্ঠির মধ্যে কেউ কোনদিন কোন শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেননি এবং শিক্ষকতা নামক পেশাটা আমাদের সমাজ ও দেশের জন্য মহা অভিশাপ। এ পেশা ও পেশাজীবীদের যত বেশি দমিয়ে রাখা যায় ততই পূণ্য বা সাওয়াবের কাজ। আসলে তারা উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু সুশিক্ষিত নয়। সু মানুষ তো নয়ই।
এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা নিয়ে কিছু বলা যাক। ‘রাস্ট্রীয় উদাসীনতা।’ দেখি এখানে আমাদের জন্য কি রাখা আছে।
মুলত রাস্ট্রে বসবাসকারি সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা সমূহ পরিপূর্ণ ও পর্যাপ্ত ভাবে পূরণের নিশ্চয়তা প্রদান করা যেমন রাস্ট্রের দায়িত্ব তেমনি সম্মানজনক পেশা গুলো ও সে সব পেশায় কর্মরত নাগরিকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করা, সম্মান ও মর্যাদা সুসংহত করা এবং সুরক্ষা সুনিশ্চিত করাও রাস্ট্রের কর্তব্য। অথচ, দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এই যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতা পেশা ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের পেশাগত নিরাপত্তা, আর্থিক, সামাজিক এবং রাস্ট্রীয় সম্মান ও মর্যাদা সাংবিধানিক ভাবে সুসংহত ও সুদৃঢ় করে রাস্ট্রীয় ভাবে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হলেও আমাদের সকলের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ নামক রাস্ট্রে এ পেশা ও পেশাজীবীদেরকে সাংবিধানিক ভাবে রাস্ট্রীয় সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা এখনো সম্ভব হয়নি। এমনকি শিক্ষকদের জন্য ‘শিক্ষক নিরাপত্তা আইনের’ব্যবস্তাও রাখা হয়নি। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা কেবলই মুখেমুখে। সাংবিধানিক বা রাস্ট্রীয় পর্যায়ে নয়। আর এ জন্যই শিক্ষকদের অবস্থা বিশেষত; বেসরকারি শিক্ষকদের অবস্থা পথের পাশে গজিয়ে উঠা গাছটার মতো। যে যখন ইচ্ছে তার ছায়ায় বসে ক্লান্তি ও শ্রান্তি দূর করে শীতল ও সতেজ হয়। আবার যাবার বেলায় সে গাছেরি ডালপালা, ছাল-বাকল ও পাতা ছিঁড়ে নিয়ে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে নিজ গৃহে ফিরে গিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে।
এই একটি জায়গা যদি ঠিক ও শক্তিশালী করা হয় তাহলে বাকি প্রায় সবগুলো কারণই সম্পূর্ণভাবে অকেজো ও বিলীন হয়ে যাবে।
লেখার কলেবর বৃদ্ধি এবং পাঠকের মনোযোগ ও ধৈর্যচ্যুতির কথা বিবেচনায় বাকি কারণগুলোর ব্যাখ্যায় গেলাম না বলে আগেভাগে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
কারণগুলো যেহেতু বলা হয়েছে সেহেতু এসবের প্রতিকারও বলা উচিত। একটা বিষয় একবারে অনিবার্য ও অকাট্য যে, শিক্ষক নির্যাতন বন্ধে রাস্ট্রকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হবে এবং তা এখনই। তবুও আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ থেকে কিছু সুপারিশ রয়েছে। সে গুলো নিম্নে তুলে ধরছি —
০১। শিক্ষকতা পেশাকে সাংবিধানিক বা রাস্ট্রীয় ভাবে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।
০২। শিক্ষক নিরাপত্তা আইন তৈরি ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
০৩।দ্রুত শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র স্কেল চালু করা।
০৪। রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘শিক্ষক ব্যাংক’ ও ‘হাসপাতাল’ স্থাপন করে সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করা।
০৫। সরকারি ও বেসরকারি নামক বৈষম্যের ‘বে’ অংশটি দ্রুত উঠিয়ে দেওয়া।
০৬। শিক্ষকদের আর্থসামাজিক স্বচ্ছলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
০৭। আইনের শাসন ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা।
০৮। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা।
০৯। শিক্ষক নেতাদের শিক্ষক বান্ধব হওয়া।
১০। শিক্ষক নেতাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও স্বার্থান্ধতা পরিহায় করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
১১। অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও চেয়ার আঁকড়ে ধরে রাখার সংস্কৃতির অবসান ঘটানো।
১২। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও পরিচালনা পরিষদ নির্বাচন সহ শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে যোগ্যতা নির্ধারণ পুর্বক তার ভিত্তিতে নির্বাচন ও নিয়োগ নিশ্চিত করা।
১৩। রাজনীতির নামে অপরাজনীতির চর্চাকে কঠোর হাতে দমন করা।
১৪। শিক্ষকদের পেশাগত দায়বদ্ধতা,আদর্শ ও নৈতিকতার উর্ধে অবস্থান করা।
১৫। সহকর্মীর প্রতি সহনশীলতা,সমবেদনা, সহমর্মিতা ও সহায়ক মনোভাব ধারণ ও চর্চা করা।
১৬। সবশেষে,সচেতনতার সাথে ঐক্যমত্য ও ঐক্যবদ্ধ থাকা।
পরিশেষ, সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয় যেদিন ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গ কি.মি (প্রায়) এর ছোট রাস্ট্র আমাদের সবার প্রিয় মাতৃভূমি প্রিয় বাংলাদেশ শিক্ষকতা পেশার সকল নির্যাতন ও বৈষম্য দূর করে এ পেশাকে এমন একটা উচ্চতায় নিয়ে যাবে যা দেখে দেশের প্রতিটি উচ্চ শিক্ষিত ও সুশিক্ষিত নাগরিক প্রথম ও প্রধান পছন্দ, লক্ষ্য ও স্বপ্ন হিসাবে শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নিবেন। আর, তা যদি বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী মানবতার জননী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে অচিরেই বাস্তবায়ন হয় তাহলে একদিকে যেমন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ’ বিনির্মান হবে অপরদিকে আমরা একটি উন্নত জাতি ও রাস্ট্র হিসাবে বিশ্ব দরবারে সিনা টান করে দাঁড়াতে সক্ষম হবো।
লেখক:
মোঃ কামরুল হাছান
শিক্ষক ও সংগঠক।
নির্বাহী সদস্য ও অর্থ সম্পাদক (কোষাধ্যক্ষ)
বাংলাদেশ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী ফোরাম।